গাড়িতে গিজগিজ করছে সড়ক। রাজধানীতে এমন যানজট নিত্যদিনের চিত্র। ছবিটি গতকাল​ সকালে কাজী নজরুল ​ইসলাম অ্যাভিনিউ থেকে তোলা। হাফিজুল ইসলাম চৌধুরী

হাফিজুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা থেকে :

পর্যটন নগরী কক্সবাজারে যানজটের চিত্র নিত্য দিনের। এই যানজট নিয়ে নানা শ্রেণিপেশার মানুষের বক্তব্যও একেক রকম। তবে ঢাকা শহরে আপনি যদি কিছুটা সময় ব্যয় করেন, ‘যানজট’ শব্দটিকে নতুনভাবে দেখা শুরু করবেন। সেই সঙ্গে শুরু করবেন কীভাবে একে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে তা-ও।

কক্সবাজার শহরে দেখবেন, রাস্তার ওপর গাড়ি। আছেন পথচারীও। হয়তো কোনো উপলক্ষে রাস্তা থাকে বন্ধ। তাই সেখান দিয়ে যাওয়া যায় না। কিন্তু ঢাকার অবস্থা ভিন্ন। ঢাকার রাস্তার যানজট, সেটা একেবারে সীমার বাইরে। এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এমন ব্যাপক ও স্থায়ী যে, এটা এ শহরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে গেছে। এটাই এ শহরের আবহাওয়া; একটা ঝড়; যা কখনো শেষ হওয়ার নয়।

ঢাকাবাসীর সঙ্গে কথা জানা গেছে, যানজট যে আসলে কী, তা বিশে^র বাদবাকি মানুষ বুঝবে না। এটা এমনই যে ভারতের মুম্বাই, মিসরের কায়রো বা যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের মতো শহরের খুব খারাপ যানজট পরিস্থিতিও তুলনামূলকভাবে ঢাকার রাস্তার গাড়িচালকদের কাছে একটা ভালো দিনের মতো মনে হবে। বিশেষজ্ঞরাও এ ব্যাপারে একমত।

বিশে^র বসবাসযোগ্য শহর নিয়ে ২০১৬ সালের এক জরিপে বলা হয়েছে, মানুষের জীবনযাত্রার মান নিয়ে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বার্ষিক প্রতিবেদনে ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকার স্থান মিলেছে ১৩৭তম। ঢাকা শুধু পেছনে ফেলতে পেরেছে নাইজেরিয়ার বৃহত্তম শহর লাগোস, লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি ও যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ককে। ঢাকার অবকাঠামোকে যেকোনো শহরের চেয়ে খারাপ হিসেবেও তুলে ধরা হয়েছে জরিপে।

উন্নয়নশীল বিশে^র অন্যান্য মেগাসিটির মতো ঢাকাও চলছে দ্রুত নগরায়ণ ও একটা আবদ্ধ শহরের পথে। এ শহরে গড়ে উঠছে রিয়েল এস্টেট বাজার, বাড়ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপস্থিতি। প্রসার ঘটছে জাঁকালো সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনযাত্রার। আর এসবে ঢাকা পড়ছে লাগামহীন দুর্দশার বিষয়: দারিদ্র্য, দূষণ, ব্যাধি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণ, উগ্র সহিংসতা ও সন্ত্রাসী হামলা।

মূল কথা হলো, যানজট আসলে ঘনত্বের ব্যাপার। যখন বহু মানুষ একসঙ্গে ছোট একটি জায়গায় ঢুকতে চায়, তখন এই জটের সৃষ্টি হয়। জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক দিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর ১২তম দেশ। কিন্তু ১৬ কোটি মানুষ নিয়ে বাংলাদেশ এই তালিকার সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ ও দরিদ্র দেশ।

ব্যাপারটা একটু ভিন্নভাবে বলি: বাংলাদেশের আয়তন রাশিয়ার আয়তনের ১১৮ ভাগ, কিন্তু রাশিয়ার চেয়ে এর জনসংখ্যা আড়াই কোটি বেশি। আমাদের দেশের এই জনসংখ্যার ঘনত্ব সমস্যা ঢাকায় আরও ঘনীভূত হয়েছে। বাস্তবিক পক্ষে, ঢাকাই বাংলাদেশ-এটাই এই সমস্যার একটা কারণ। দেশের সরকারি কার্যক্রম, ব্যবসা-বাণিজ্য, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও চাকরির সিংহভাগ ঢাকায় কেন্দ্রীভূত। প্রতিবছর প্রায় চার লাখ মানুষ ঢাকায় আসছে। এই বিপুল অভিবাসনের কারণে ঢাকা এখন বিশে^র সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ মেগাসিটি, সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল শহরগুলোর একটি।

ঢাকা শহরে এক কোটির বেশি মানুষ বসবাস করে। এখানে মৌলিক অবকাঠামো নেই বললেই চলে। সঙ্গে রয়েছে আইনের শাসনের অভাব। অথচ একটি শহর বসবাসযোগ্য হতে হলে এগুলো প্রয়োজন। ঢাকায় ট্রাফিক বাতির সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়। যদিও এগুলো কমবেশি আলংকারিক। খুব কম চালকই এই বাতির সংকেত মেনে চলেন। ঢাকার নৈরাজ্যকর রাস্তার প্রধান সমস্যাই হচ্ছে এখানে রাস্তার পরিমাণ কম।

ডেইলি স্টার-এর এক প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকায় রাস্তার পরিমাণ শহরের মোট আয়তনের মাত্র ৭ ভাগ (প্যারিস ও বার্সেলোনার মতো ১৯ শতকের শহরে সড়কের পরিমাণ ৩০ ভাগ)। ফুটপাতও একটা সমস্যা। ঢাকায় হাঁটার রাস্তা খুব কম। যা আছে তাও হাঁটার অযোগ্য, হকার ও গরিব মানুষের দখলে।

সরকারি হিসাবমতে, ঢাকার যানজট প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘন্টা খেয়ে ফেলছে। ফলে শহরের অর্থনীতি থেকে প্রতিবছর কোটি কোটি ডলার নষ্ট হচ্ছে। আবার মানুষের জীবনযাত্রার ওপরও এই যানজটের অন্য রকম প্রভাব রয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন- ‘ঢাকা শহর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হয়ে গেছে। এই যানজটের কারণে মানুষ সামাজিকতা করতে পারে না। আপনি হয়তো মাঝেমধ্যে বন্ধু বা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যেতে চাইবেন, কিন্তু এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে অনেক সময় লেগে যায়।’

সমাধানের উপায়: ঢাকা শহরের এই দুর্দশার সমাধান কী হতে পারে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা সবাই কমবেশি একই কথা বলেন। তাঁরা ট্রাফিক বাতি, রিকশার জন্য আলাদা লেন, গুরুত্বপূর্ণ শাখা সড়ক ও হালকা ট্রেনের কথা বলেন। তাঁরা বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলেন। বলেন চট্টগ্রাম ও খুলনার মতো নগরকে দ্বিতীয় প্রধান শহর হিসেবে গড়ে তুলে ঢাকার ওপর চাপ কমানোর কথা। সরকার তার দিক থেকে বলছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কথা। ২০১৫ সালের আগস্ট মাস থেকে এর কাজ শুরু হয়েছে। ১২ মাইলের এ সড়কের নির্মাণে খরচ হবে ১ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ঢাকায় এ ধরনের প্রকল্প নিয়ে গভীর সংশয় থাকে।

ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দারা বলছেন- তাঁদের প্রায় সবার কাছে যানজট একটা আতঙ্ক, ধৈর্য ও সাহসের পরীক্ষা। তবে একই সঙ্গে অন্য ধরনের গর্ব করার মতো বিষয়ও। সারা জীবন ঢাকায় থাকা এক নারী বলেন, বিদেশে অবস্থানের সময় ঢাকার যানজট তিনি ‘মিস করতেন’। ইউরোপ-আমেরিকার বড় শহরগুলোতে তুলনামূলকভাবে যানজট কম থাকায় তিনি খুব অধীর হতেন। ঢাকায় যদি আপনি যানজট ঠেলে কোনোভাবে গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারেন, তাহলে ধরে নিতে পারেন আপনি বড় ধরনের জয় পেয়েছেন। ঢাকার যানজট আপনার মনকে চিন্তার একটি খোরাক দেবে।